আমার বাড়ী শিলিগুড়ি। আজকে আমরা ঘুরতে যাচ্ছি অহলধারা, সেলফু হিলস্, শিটং এবং রামদুরা, দুই রাত্রি তিন দিনের জন্য। আমাদের যাত্রার শুভারম্ভ। আমরা এখন শালুগাড়া পেরিয়ে সেবকের কালীবাড়ীতে এসে পৌঁছেছি। রাস্তায় আসার সময় সেবক বাজারে, রেললাইনের ঠিক আগে পৌঁছে আমরা দেখলাম কিছু ভালো ভালো রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে। সেবকের কালীবাড়ী খুব প্রাচীন এবং জাগ্রত। প্রতিবারের মত এবার ও আমরা মাকালীর আশীর্বাদ নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম। মন্দির থেকে দশপা এগিয়ে আমরা আলুকাবলি খাওয়ার জন্য দাঁড়ালাম। বিশ বছর যাবত কাকা এই আলুকাবলি বিক্রি করে যাচ্ছেন।খাওয়া শেষ করে আমরা আবার রওনা হলাম। কিছু পরেই বাকপুল এল। এখান থেকে দুটো রাস্তা আলাদা হয়ে গেছে। একটি গিয়েছে ডুয়ার্স- ভুটান -আসামের উদ্দেশ্যে, অন্যটি সিকিম -শিটং -কালিম্পং। আমরা শিটং এর রাস্তা ধরে এগোলাম। আমরা এখন কালিঝরা পার হচ্ছি। এখানে অনেক বছর আগে অমিতাভ বচ্চনের ‘অনুসন্ধান ‘বইয়ের শুটিং হয়েছিল। এখন এখানে একটি জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। এখন আমরা কালিঝরা পার করে সেতুঝরা পৌঁছাব। এখানে বর্ষায় প্রচুর ল্যান্ডস্ লাইট হয়। এখান থেকে তিস্তার অপরূপ দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। এবার সেতিঝরা পেরিয়ে হনুমানঝরায় এলাম। এই খুব সুন্দর মন্দিরটি কিছুদিন আগেই তৈরি হয়েছে। হনুমানঝরা পার হওয়ায় কিছুটা পর একটি বাঁক এল। আঞ্চলিকদের কাছ থেকে জানতে পারলাম এর নাম লোহাপুল মোড়। এখান থেকে একটি বাঁক সোজা সিকিম -কালিম্পং চলে গেল, আর বাঁ দিকের বাঁকটি ধরে আমরা শিটং এর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলাম। আমাদের অফবিট লোকেশান এখান থেকেই শুরু। স্হানীয়দের কাছ থেকে জানতে পারলাম -এখন যে গ্রামটি প্রথম আসবে তার নাম অহলধারা। এখানে পৌঁছে আমরা ভাবলাম একটি হোমস্টেতে দুপুরের আহারটা সেরে নেব। শিলিগুড়ি থেকে আনুমানিক 54 কিমি দূরে এবং 4,500 ফিট উচ্চতায় অহলধারায় পৌঁছতে আমাদের ঠিক 1 ঘন্টা 40 মিনিট সময় লেগে গেল। একটি দিদির হোমস্টেতে এসে উঠলাম। শিলিগুড়ির শহুরে কোলাহল ভিড়ভাড়যুক্ত পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আমরা এক গ্রাম্য বৈচিত্র্যপূর্ণ পরিবেশ আবিষ্কার করলাম। খুব কম লোকের বসতিপূর্ন এই অহলধারা গ্রামটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে অপরূপ, চারিদিকে মনোরম শান্ত পরিবেশ। স্হানীয়দের মতে ,এখানকার সূর্যোদয় খুবই অভাবনীয়,মহিমান্বিত।
আমরা এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করে লাঞ্চ সেরে বেরিয়ে পড়লাম শিটং এর উদ্দেশ্যে। অহলধারা গ্রামটি থেকে আনুমানিক 3 কিমি দূরে আমরা সেলফু হিল পৌঁছলাম। এখান থেকে রাস্তাটি তিনটি ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। বামদিকে লাটপাম্চার, সোজা পথটি রামদুরা -কার্শিয়াং এবং ডানদিকে শিটং। ডানদিকের শিটং রুট ধরে আমরা এগোলেই 15-20 মিনিট পরেই আমরা শিটং পৌঁছে গেলাম।
শিটং পৌঁছে আমরা দেখলাম এখানকার তাপমাত্রা শিলিগুড়ির মতোই নর্ম্যাল। শিলিগুড়ি থেকে প্রায় 63 কিমি দূরে এবং 2800 ফিট উচ্চতায় অবস্থিত এই ছোট গ্রামটিতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে এল। গ্রামবাসীদের কাছ থেকে জানতে পারলাম বেঙ্গলের যেখানে যেখানে কমলালেবুর চাষ হয় তার মধ্যে এখানকার কমলালেবু স্বাদে অতুলনীয় এবং ফলনও খুব বেশী। এখানে আমরা যে হোমস্টেতে আছি, এর টয়লেট ওয়েস্টার্ন, রুম নীট এন্ড ক্লীন ।চা আর পকোরা আমরা স্নেক্সে পেলাম। এখানকার বুকিং দুভাবে হয় । (1)শুধুমাত্র রুম বুকিং (2 ) অলমিল রুম বুকিং। আমাদের কাছে অলমিল উইথ রুম বুকিং গুডডিল বলে মনে হল। আমাদের মাথা পিছু 1450 করে লাগল। আমরা চা খেতে খেতে হোটেলের মালিক এবং স্হানীয় গ্রামবাসীদের সঙ্গে গল্প করে অনেক তথ্য সংগ্রহ করলাম। এই পুরো গ্রামটি অরেঞ্জ বাগানের সঙ্গে যুক্ত।এখানকার লোকেদের প্রধান জীবিকা এই অরেঞ্জ বাগান। এই অরেঞ্জ বাগান দেখার জন্য প্রচুর পর্যটক নভেম্বর থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সময়টাতে এখানে ভিড় করেন। আর সেই চাহিদা অনুযায়ী প্রচুর হোমস্টে এখানে গড়ে উঠেছে। এখানে আঞ্চলিক অন্যান্য ফেস্টিভ্যাল এর সঙ্গে অরেঞ্জ ফেস্টিভ্যাল একটি বড় ফেস্টিভ্যাল। এবার আমরা রাত 8 টায় রাতের খাবার ও পেয়ে গেলাম। মেনু ছিল ইয়েলো ডাল, রাঁই শাক, আলুভাজা, সবজি এবং চিকেন ক্যারি। আমরা খেতে খেতে জানতে পারলাম সবজি এবং ডাল এখানকার লোক্যাল জমিতে অরগ্যানিক পদ্ধতিতে চাষ করা হয়। রাঁইশাকের টেস্ট ছিল অসাধারণ। এবার ঘুমের পালা। কাল ভোরে অনেক কিছু আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে।
2য় দিন সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে আমরা কমলালেবুর বাগান দেখতে ছুটলাম। উঃ না দেখলে ভাষায় প্রকাশ করা দুষ্কর। চারদিকের এই অপরিমেয়, পরিশ্রুত প্রকৃতি উপভোগ করার জন্য প্রকৃতি প্রেমীদের এখানে আসতেই হবে।হোটেলে এসে পুরি, সবজি এবং আলুর দম ,ডোলে -খুর্সানীর চাটনী মোমো আর চা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারলাম। নদীর পাশে অবস্থিত হোমস্টেটিতে চা খেতে খেতে চারদিকের ছড়িয়ে থাকা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের আমেজ নিলাম। ব্রেকফাস্ট শেষে একটু বিশ্রাম নিয়ে, ফ্রেশআপ হয়ে আমরা আমাদের ল্যাগেজগুলো রিসেপসন্ এ রেখে চারপাশে হাঁটতে বেরুলাম। 11 টার দিকে চেকআউট টাইম। যেহেতু আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল মালদ্বিরাম ,তাই আমরা শিটং হোমস্টেতেই 11.30 আরলি লাঞ্চ করে নিলাম। আফটার লাঞ্চ আমরা মালদ্বীরামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। রাস্তার দুধারে সারিবদ্ধ সবুজ বনানী।আমাদের দুর্ভাগ্য এটাই যে চারিদিকের ঘন কুয়াশায় আমরা প্রকৃতির পরিপূর্ণ মজা অবলোকন করতে পারলাম না।
এমনি ভাবেই আমরা মালদ্বীরামে পৌঁছে গেলাম। তখন ঠিক দুপুর আড়াইটে, রাস্তায় কুয়াশায় জন্য গাড়ি আস্তে চলেছে। এখানে এসে আমরা চা বাগান লাগোয়া একটি হোমস্টে দেখে বুকিং করে ফেললাম। এখানকার লোকসংখ্যা খুবই কম। মাত্র ছয়টা হোমস্টে এখানে গড়ে উঠেছে।
আমরা হোমস্টে থেকে বেরিয়ে স্হানীয় একটা চায়ের দোকানে বসে চায়ের আমেজ নিতে নিতে স্হানীয়দের থেকে জানতে পারলাম এখানকার অধিবাসীরা নির্মল প্রকৃতির মতোই সরল, সাদাসিধে। মহানন্দা ওয়াইল্ড লাইফ সেঞ্চুরির মধ্যে অবস্থান করছে এই গ্রামটি। এর উচ্চতা 5,800 ফিট। এখানে বসতি বলতে মাত্র 28 টি পরিবারের বা ঘরের। এখানকার নূন্যতম জীবিকা চাষবাস, তা আবার বয়স্করাই করে থাকেন। আর ইয়াং ছেলেমেয়েরা বেশীরভাগই কাজের সন্ধানে কার্শিয়াং-দার্জিলিং -কালিম্পং চলে যায়। কিছু মানুষ চা এবং ফার্মিং এর সঙ্গে জড়িত। গল্প শেষে আমরা হোমস্টের রুমে চলে এলাম। রাতের খাবারে চিকেন, রাইস আর চিপস্ ছাড়া কিছুই পাইনি।বাইরে ঠান্ডা খুবই অনুভূত হল। তাড়াতাড়ি ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে ও পরলাম ।
আজকে আমাদের ভ্রমণের তৃতীয় দিন। ইচ্ছে করেই দেরী করে ঘুম থেকে উঠলাম। উঠে দেখি কালকের মত কুয়াশা আর নেই। কি অপরূপ দৃশ্য! প্রকৃতি তার শ্যামল প্রাকৃতিক রূপ সৌন্দর্য্য যেন তুলে রেখেছে। একপাশে ঘন জঙ্গল এবং ঝাউগাছ ,অপরপাশে বিস্তীর্ণ চা বাগান। আমরা ব্রেকফাস্ট সেরে 10 টার দিকে মালদ্বীরাম হোমস্টে থেকে বেরিয়ে কার্শিয়াং টুরিস্ট লজ্ এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ওখানেই লাঞ্চ করব সিদ্ধান্ত নিলাম। ডাউহিল হয়ে কার্শিয়াং এর বাজারে নামার 15 মিনিটের সিঙ্গেল রাস্তাটি খুবই রোমাঞ্চকর লাগল।
কার্শিয়াং পৌঁছে টুরিস্ট লজ্ এ নেমে আমি এক প্লেট মোমো খেয়ে নিলাম। অতুলনীয় স্বাদ সেই মোমোর। অর্ডার অনুযায়ী লাঞ্চ চলে এল। সিস্টেম্যাটিক সেই লজ্ এ বসে তৃপ্তি করে লাঞ্চ সেরে শিলিগুড়ি বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। পাঙ্খাবাড়ী হয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের সেই চেনা পরিচিত শহর শিলিগুড়িতে।

AkkCrusier

2 Replies to “Shitong – unforgettable offbeat tour in Darjeeling”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *